অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
মজলুম সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান এর কুষ্টিয়ায় আগমনে দুধের মাছিদের আনাগোনা বেড়েছে। ‘দুধের মাছি’ বাগ্ধারার সাথে আপনি নিশ্চয়ই পরিচিত। যার অর্থ সুসমর বন্ধু। মাছি দুধ বা দুধের তৈরি খাবার দেখলে খাওয়ার জন্য এগিয়ে আসে। একইভাবে কিছু বন্ধু আছে, যারা সুখের সময় পাশে থেকে শুধু নিজে ভোগ করার চিন্তা করে। খারাপ সময়ে তাদের আর দেখা যায় না। তবে জেনে রাখা ভালো, মাছির সব প্রজাতি এক রকম খাবার পছন্দ করে না। কোনো কোনো মাছি মাছ-মাংস পছন্দ করে, কেউ পছন্দ করে পাকা ফল। দু ধরনের মাছিই এখন ব্যস্ত মাহমুদুর রহমানকে বরণ করে নিতে।
সেদিন ছিল সম্ভবতঃ ২২ জুলাই’ ২০১৮, রবিবার। কুষ্টিয়া আদালত চত্বরে পুলিশের সামনেই আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। সেদিন আমি প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অবলোকন করার সুযোগ হয়েছিল। ওই পত্রিকার প্রতিনিধি ও মাহমুদুর রহমান স্যারের পরিচিত হওয়ায় তাঁর কুষ্টিয়া আগমন, থাকা, খাওয়া, জামিন, নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে আমি বেশ ওয়াকিবহাল ছিলাম।
মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়া ছাত্রলীগের এক নেতা মানহানির মামলা করেছিল। সেই মামলায় দুপুর ১২টায় কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক এম এম মোর্শেদ ১০ হাজার টাকা জামানতে মাহমুদুর রহমানকে জামিন দেন। জামিন মঞ্জুরের পর থেকে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা আদালত চত্বরে মাহমুদুর রহমানকে অবরুদ্ধ করেন। এ সময় তারা মাহমুদুর রহমানের বিচার চেয়ে আদালত চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল করেন। মাহমুদুর রহমান সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক এম এম মোর্শেদের এজলাস কক্ষে অবস্থান করেন। এর মধ্যে কয়েক দফায় এজলাস কক্ষ থেকে মাহমুদুর রহমান বের হওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তাকে বহন করা প্রাইভেটকার দুই দফায় তাকে নেয়ার জন্য আসলেও ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা গাড়ি ধাওয়া করে। একপর্যায়ে দুপুরে মাহমুদুর রহমান ফেসবুক লাইভে এসে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানোর পাশাপাশি সরকারের সমালোচনা করে প্রায় ৪ মিনিট বক্তব্য দেন। সেই সময় কুষ্টিয়ার এসপি হিসেবে ছিলেন মেহেদী হাসান। যিনি ফ্যাসিস্ট সরকারের গুন্ডা হিসেবে কাজ করায় বর্তমান জনরোষে প্রাণ বাঁচাতে পলাতক রয়েছেন। মাহমুদুর রহমানের সাথে থাকা জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আব্দুল্লাহ ভাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলে সার্বিক অবস্থা জানান। তিনি নিরাপত্তা বিষয়ে আশ্বাসও দেন। সেদিন অধিকাংশ মিডিয়াতে মাহমুদুর রহমানের কুষ্টিয়া আদালতে অবরুদ্ধ থাকার সংবাদটি গুরুত্বের সাথে প্রচার ও প্রকাশ করেন। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। সেদিন কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি নাসির উদ্দিন হামলাকারীদের সাথে মিশে গিয়ে তামাশা দেখেছিলেন।
অবশেষে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক এম এম মোর্শেদের এজলাস কক্ষ থেকে প্রাইভেটকার নিয়ে যশোরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার সময় আদালত চত্বরে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের হামলার মুখে পড়েন মাহমুদুর রহমান। হামলাকারীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায়। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে মাহমুদুর রহমান গাড়ি থেকে নেমে কুষ্টিয়া জজ কোর্টের এক চিহ্নিত মহিলা আওয়ামীলীগের কথিত নেত্রী বর্তমান পলাতক সামস তানিম মুক্তির চেম্বারে ঢুকে পড়েন। সেখানেও তার নেতৃত্বে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালান। হামলায় মাহমুদুর রহমান গুরুতর আহত হন। মাহমুদুর রহমানের ব্যবহৃত গাড়িটি ভাঙচুর করা হয়। একপর্যায়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মাহমুদুর রহমানকে উদ্ধার করে একটি অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয়া হয়। সেদিন বহু অসময়ের বন্ধু পালিয়ে গিয়েছিল। নিজের জীবন বাজি রেখে সেদিন কাজ করেছিলেন আমার দেশ পত্রিকার কুষ্টিয়ার জেলা প্রতিনিধি বরকত আলী মাজেদ ও বৈশাখী টেলিভিশনের কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি রবিউল ইসলাম দোলন।
প্রসঙ্গত, সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা ও তার ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিক সম্পর্কে মানহানিকর বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়ায় মামলা হয়। ওই মামলায় জামিন পেতে কুষ্টিয়া আদালতে তিনি এসেছিলেন।
সেদিন আওয়ামীলীগের কথিত সাংবাদিকেরা বলেছিল রক্তের বদলা রক্ত। উল্লেখ্য, ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসলে সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী একটি প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দিতে কুষ্টিয়া এসেছিলেন। সেদিন কুষ্টিয়া পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে বিএনপির লোকদের ছোড়া ইটের আঘাতে কপাল ফেটে রক্তাক্ত হয়েছিল ইকবাল সোবহান চৌধুরী।
আগামীকাল বৃহষ্পতিবার মাহমুদুর রহমান কুষ্টিয়া আসছেন। তা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাজ সাজ রব। সুদিনে মানুষের বন্ধুর অভাব হয় না। মাহমুদুর স্যারকে মনে রাখতে হবে এদের অধিকাংশই হচ্ছে সুযোগসন্ধানী কৃত্রিম বন্ধু। এরা সব সময়ই নিজের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত থাকে। দুর্দিনে এদের খুঁজে পাওয়া ভার। সমাজে কিছু স্বার্থপর ও সুযোগসন্ধানী মানুষ আছে, যারা শুধু নিজেদের স্বার্থ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। কেবল নিজেদের প্রয়োজনেই তারা অন্যান্য লোকের সাথে মেশে। স্বার্থ হাসিলের জন্যে তারা অন্যের তোষামোদ করে, প্রয়োজনে চাটুকারের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়। অন্যের সৌভাগ্য থেকে কিছুটা ভাগ পাওয়ার জন্য সুযোগসন্ধানীরা সাময়িকভাবে মানুষের ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়। কিন্তু দুঃসময়ে বিপদ দেখে কেটে পড়ে। সত্যিকার বন্ধু সে-ই, যে বন্ধুর বিপদের দিনে এগিয়ে আসে, তার পাশে থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
এখন যারা মাহমুদুর রহমানের সংবর্ধনা নিয়ে খাওয়া দাওয়া ঘুম নষ্ট করে ফেলেছেন, সেদিন কোথায় ছিলেন? পাঠকদের কাছে বিচারের ভার দিয়ে লেখার ইতি টানলাম।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, কলামিস্ট ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮, ইমেইল: seraj.pramanik@gmail.com
বিস্তারিত জানতে ভিডিওটি দেখতে পারেন
https://www.facebook.com/share/v/J8yLEsRjoADeXXfS/